রাত ১২.০৮ টা বাজে। যশোর বেজ পাড়া। চারদিকে নিরবতার সুনসান। এই সময়ে কেউ জেগে থাকে না। তবে দুই শ্রেণি মানুষ জেগে থাকে,,যারা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, কিংবা বর্তমানের জীবনে হিসাবনিকাশ যারা মেলায়। আমি জেগে আছি অতি আনন্দে।
ফটো: এই আই (AI) থেকে
এই আনন্দ অবশ্যই আমি একা। কেউ এই আনন্দে ভাগিদার নয়। আমার ক্ষেত্রে সবকিছু বিপরীত বলবো না,,বরং বিপরীত ঘটনাটা আমাকে ভাবায়। প্রতিটি ঘটনা গ্রহ নক্ষত্রের মতো নিয়ম করে না ঘটলেও ঘটে চলেছেে আমার নিজের গতিতে। প্রকৃতির একটি রেভেন্জ বলে একটি শব্দ আছে,,,আমি ওইটাতে ব্যাখ্যা দিতে পারবো না,,,তবে পরিপক্ব স্টেজে এসে ভার সইতে না পারা গল্পগুলো মাঝে মাঝে চরিত্র খোঁজে বেড়ায়। বিশ্বাসের গল্পের খাতা অনেক ভারী হয়ে উঠেছে,,,ভালবাসা নামক অতি তুষ্টগুলো গতি হারাচ্ছে রাতের গভীরতার সাথে পাল্লা দিয়ে।
আমি পাল্লা দিয়ে চলেছি নিজের সাথে, নিজের আত্নার সাথে। জ্ঞানতত্ত্বের প্যারাডাইম কবে যে উন্মোচন ঘটে, কিংবা সংসার নামক প্রি-প্রস্তুুতি জটিল প্রক্রিয়ায় দুটি বিপরীত লিঙ্গের নরনারী আপন ঠিকানা খোঁজে নীড়ে ফিরতে গিয়ে আস্থার বিক্রিয়া ঘটায় এসব আমাকে ভাবিয়ে বেদনার আনন্দ
সঙ্গ করে আমি খোঁজে চলি আমার সন্ধানে,,,,, এই পথ শুধু সহজ নয়,এটি অতি সহজ ও একই সাথে কন্টকপূর্ণ । তবে এর মাত্রা ও পরিধি অতি ভয়ানক হয়ে উঠলেও আমি নীরব থাকি। খুবই নীরব। একেবারে কপোতাক্ষ নদের ন্যায় স্রোতবিহীন নীরব। কারো ফোনকল, কারো মায়া আমায় স্পর্শ করতে পারে না। ঠিক ঐ মুহুর্তে ভেবে চলেছি যশোরে আসার সময় আমার থেকে ৪২৬
কি.মি দূরে থাকা আলুটিলায় বোতল কুড়ানো ত্রিপুরা মহিলার কথা। আমার হৃদয় ছুঁয়েছে তিনি, ক্ষতবিক্ষত করেছে, ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে একসময় আত্ননির্ভশীল আদিবাসী গ্রামের কথা। এখন মরুভূমির মতোই, প্রকৃতির আর্শীবাদ আর নেই।তাই তো তিনি বোতল কুড়াচ্ছে আলুটিলায়, কমলাপুরের রেলস্টশনের বস্তিদের মতোই, রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া বোতল বস্তায় বন্দি করে পিঠে হেলান দিয়ে রেখে আইসক্রিম চুষতেছে,,, কিন্তু আইসক্রিমটাকে বেশীক্ষণ মূখে রাখতে পারল না,কারন এটি ঠান্ডা বরফ জাতীয়,,, যতটুকু পারে মুখে দিয়ে স্বাদটা নেওয়ার চেষ্টা করছে,,, হালকা পাতলা বাষ্পে ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে। কারো খাওয়ার দৃশ্য দেখা রুচি ও শোভা পায় না জেনেও, তবুও এই দৃশ্যটা আমি দেখেই চলছি, মনছুঁয়েছে এই কারণে '' কারণ সেই প্রচন্ড ক্লান্ত পথিকা। না ভুল হয়েছে। কারো মা বা কারো বোন তিনি । রাষ্ট্রে শোষনে নিষ্পেষিত পথের যাত্রী তিনি, পরনে তার সাদামাটা নকশাবিহীন রিনাই ( থামি)। এই মুহুর্তে তার পলকের ইঙ্গিত আমার দিকে নয়, বাদাম আমড়া আচার ফেরি করে, বিক্রি করা, বিক্রেতার দিকে। হয়তো কিছুক্ষণ পর আরো কিছু একটা কিনে খাবে। সত্যিই এবার কিনেছে বড়ই এর আচার। মুখে কয়েকটা পুড়ে ঝিমিয়ে নিলেন, অতক্ষণে গাড়ি চলছে আমার। গাড়ি হর্ণে তার হুঁশ ফিরে, আমার দিকে তাকিয়ে বোধহয় বলতে চেয়েছিল তার, রাষ্ট্রের প্রতি কিছু অর্থকরীর মায়াবী আবদার এর কথা : তিনি বলতে চেয়েছিল তিনি গরীব ও অলস নয়, তিনি মানসিকভাবে ধনী। কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থার নিষ্ঠুর অর্থনীতি শিকার তিনি।রাষ্ট্র শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে নি বলে তিনি এই বঞ্চনায় শিকার হয়ে আসছে। তাকে গরিব বানানোর জন্য রাষ্ট্র সব ধরনে আয়োজন করে রেখেছে।
এরকম আয়োজনে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র তাকে নিম্নের আয়োজনে অংশীদার করতে পারতো :
নারী বুনন দক্ষতা: মানুষ যখন একটা কাজ করতে করতে দক্ষতা অর্জন করে তখন তাকে আমরা বিশেষায়িত দক্ষতা বলি। এটির সাথে জড়িয়ে আছে ব্যাক্তির কাজের আনন্দ। এই ধরনে কিছু বিশেষায়িত দক্ষতা আদিবাসী নারীদের মধ্যে রয়েছে সেটি হলো নিজস্ব সংস্কৃতি অবয়বে পোশাক বুনন দক্ষতা। তাদের অর্জিত এই গুনাবলি রাষ্ট্র কাজে লাগাতে পারছে না। তাদের কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে অধিক পরিমান পোশাক বিদেশি রপ্তানি কিংবা রিনাই রিশা( পিনন) ডিজাইনকে ঠিক রেখে আধুনিক নতুন নতুন নকশায় রুপ প্রদান করা।
তিনি আরো বলার চেষ্টা করছেন হয়তো, তার হাজবেন্ড হতে পারতো হস্তশিল্প ও নির্মাণশিল্পের কারিগর: আধুনিক বাঁশ বেতের ফার্নিচার শহরে আভিজাত্যের তালিকায় স্থান করে নিতে পারতো, এই বাহারি রঙের নকশার দক্ষতা আধুনিক যন্ত্রপাতিতে উৎপাদন হতে পারতো তাদের হাত ধরে।
তার ক্ষুধার্ত জীর্ণশীর্ণ চেহারা কথা বলে, তার খাদ্যাভ্যাস যোগ হতে পারত নিজস্ব বাহারি রঙের আইটেম। পৃথিবীব্যাপী যেখানে নদী নেই, নদী সীমিত, পাহাড় পর্বত সেখানে মাছের চাহিদা পূরনের জন্য মাছ সংরক্ষণ করে প্রসেসিং করে শুটকি নাপ্পি জনপ্রিয়তা দেখা যায়। সেই জনপ্রিয়তা পার্বত্য চট্টগ্রামেও ব্যাতিক্রম নয়। কিন্তু তিনি দীর্ঘদিন ময়লা পরিবেশে উৎপাদন হওয়া নাপ্পি খেয়ে অসুস্থ হয়ে আসছে। তাই নাপ্পি কারখানা মাধ্যমে যেমন তার কর্মসংস্থান হতো, একই সাথে আমিষের চাহিদাও পূরন হতে পারতো।
আরো কত কি হতে পারত !
@ ধীমান ত্রিপুরা ( নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী)
0 Comments