পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতিহাসের ধারায় গড়ে ওঠা ত্রিপুরা, চাকমা, মারমা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, খিয়াং, খুমি, বম, লুসাই, পাংখোয়া, চাক, কুকি প্রভৃতি ১৩টি জাতিগোষ্ঠী ও সাথে বসবাসকারী বাঙালিরা মিলে ১৪টি জাতিগোষ্ঠী বসবাস করছে।
তবে বাস্তবে এই জাতিসমূহকে আলাদাভাবে স্বীকৃতি না দিয়ে, নামকরণের এক রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে মাত্র দু'টি ছদ্ম-পরিচয়ে সংকুচিত করা হয়েছে — "পাহাড়ি" ও "আদিবাসী"।
এই নামকরণের রাজনীতি জাতিগত স্বাতন্ত্র্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
ফটো: এই আই থেকে বানিয়ে নেওয়া।
নামকরণের সংকট: পরিচয়ের সংকোচন
ব্যক্তিগত পরিচয়ে একজন মারমা, চাকমা, বা ত্রিপুরা সদস্যকে যখন প্রশ্ন করা হয় — "তুমি কি পাহাড়ি?" — তখন প্রকৃত জাতিগত পরিচয় হারিয়ে যায়।
প্রকৃতপক্ষে প্রশ্ন হওয়া উচিত ছিল: "তুমি কোন জাতির?"
এই অব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক করতে গিয়ে ১৩টি ভিন্ন জাতি বাধ্য হয়ে একক "পাহাড়ি" বা "আদিবাসী" পরিচয় গ্রহণ করে। তাদের মূল জাতিগত বৈচিত্র্য ও নিজস্বতা উপেক্ষিত হয়।
অর্থাৎ, জোর করে চাপানো হয় একটি সামষ্টিক ছায়া-পরিচয়।
রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক ভূমিকা
রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে যখন "পাহাড়ি" শব্দটি ব্যবহৃত হয়, তখন ১৩টি ভিন্ন জাতির বাস্তবতা ও বৈচিত্র্য উপেক্ষিত হয়। বরং আরো তাদেরকে "উপ-জাতি" বা "ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী" ইত্যাদি শব্দে খণ্ডিত করে গুরুত্বহীন করা হয়।
এই প্রক্রিয়া মূলতঃ জাতিসত্তাকে দুর্বল করার ও একীভূত জাতীয়তাবাদের নামে আত্মপরিচয় মুছে ফেলার সূক্ষ্ম রাজনৈতিক কৌশল।
যেখানে "আদিবাসী" শব্দটিও বিতর্কিত করে, সরকার "ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী" হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টা চালায়, অথচ বাঙালিদের 'বৃহৎ নৃগোষ্ঠী' বলে কেউ আখ্যায়িত করে না — বরং সরাসরি "বাঙালি" নামে পরিচয় দেওয়া হয়।
প্রশ্ন উঠে:
যদি আদিবাসীরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হয়, তবে বাঙালিরাও বৃহৎ নৃগোষ্ঠী — এটিই সমতাবোধের দাবি।
উন্নয়ন ও সংবেদনশীলতা: বৈষম্যের চিত্র
উন্নয়ন বাজেট কিংবা চাকরি বণ্টনে ১৪টি জাতির জনসংখ্যার অনুপাতে ভাগ না দিলে, তা কিছু জাতিকে সুবিধাপ্রাপ্ত ও বাকিদের বঞ্চিত করে।
পার্বত্য অঞ্চলে এক কোটি টাকার বাজেট হলে:
মারমা, ত্রিপুরা, চাকমা, তঞ্চগ্যা, বাঙালি — সকলের অনুপাতে বরাদ্দ নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
শিক্ষক নিয়োগ, সরকারি চাকরি ও বই-পুস্তক বণ্টনেও অনুপাতে সুযোগ দেওয়া জরুরি।
অন্তত স্থানীয় চাকরিগুলিতে নিজস্ব ভাষায় পরীক্ষার সুযোগ থাকা উচিত।
কেননা, বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশে সব ভাষা ও সংস্কৃতির যথার্থ প্রতিনিধিত্ব না থাকলে প্রকৃত দেশপ্রেম ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
সেনাবাহিনীর ভূমিকা: বন্ধুত্ব না তদারকি?
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ত্রাণ বিতরণ, চিকিৎসা সেবা প্রদান ইত্যাদি কার্যক্রম চালায়।
কিন্তু এগুলোর পেছনে রয়েছে তিনটি সম্ভাব্য উদ্দেশ্য:
১. জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেওয়া।
২. জনবান্ধব ভাবমূর্তি তৈরি করা।
৩. অতীতের নির্যাতনমূলক সম্পর্কের স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা।
অথচ পাহাড়িদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে আত্মবিশ্বাসী ও সমান মর্যাদার নাগরিক করে গড়ে তোলার কাজ বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোরই করা উচিত ছিল।
মিডিয়ায় জাতিগত রাজনীতি
সমতলে কোনো অপরাধের খবর প্রচার করলে বলা হয় "অমুক সন্ত্রাসী", কখনো "বাঙালি সন্ত্রাসী" বলা হয় না।
কিন্তু পাহাড়ে কোনো ঘটনা ঘটলে বলা হয় "পাহাড়ি সন্ত্রাস"।
এমনকি রাজনীতির মঞ্চেও "পাহাড়ি আওয়ামী লীগ" বা "পাহাড়ি বিএনপি" বলে ভিন্ন জাতিগত বিভাজন তৈরি করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে:
জাতিগত ভিত্তিতে দায় আরোপ না করে — ব্যক্তি বা সংগঠনভিত্তিক সমালোচনা করা উচিত।
ভূমি অধিকার প্রশ্ন
ঐতিহাসিকভাবে পাহাড়ি ভূমি কখনো বাঙালিদের ছিল না।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তবে তা পাহাড়িদের স্বত্বাধিকার খণ্ডন করে নয়।
বাঙালিরা ঐতিহ্যগতভাবে সমতলভূমির জাতি; জোর করে পাহাড় দখলের ন্যায্যতা নেই।
ভূমি দখল ও বসতি স্থাপনের প্রবণতা পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শেষ কথা:
যে কোনো জাতির আত্মপরিচয় নির্ধারণের অধিকার সেই জাতির নিজস্ব বিষয়।
এটি রাষ্ট্র বা অন্য কোনো জাতির চাপিয়ে দেওয়া যায় না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩টি জাতিগোষ্ঠীকে সম্মানের সাথে তাদের নিজস্ব পরিচয় ও ভাষা-সংস্কৃতির স্বীকৃতি দিতে হবে।
একটি বহুজাতিক, বহুভাষিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন:
ন্যয্যতা,
বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি,
সম্মানিত সহাবস্থান।
না হলে জাতিগত বৈষম্য শুধু পাহাড়িদের নয়, গোটা বাংলাদেশের অগ্রগতিকেই বাধাগ্রস্ত করবে।
ধীমান ত্রিপুরা
বি.এস.এস(অনার্স), এম.এস.এস ( নৃবিজ্ঞান) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
1 Comments
Excellent guru
ReplyDelete