Deman Tripura

ভাষা ও শব্দের এস্টাবলিশমেন্ট রাজনীতি

ভাষা হলো আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহন। এই ভাষার মৌলিক একক হলো শব্দ। শব্দের সমন্বয়ে ভাষা তৈরি হয়, আবার শব্দের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে সংস্কৃতি, চেতনা ও ক্ষমতার বলয়।

শব্দ শুধু যোগাযোগের হাতিয়ার নয়; কখনো কখনো এটি হয়ে ওঠে একধরনের হেজেমনিক (আধিপত্যমূলক) অস্ত্র। সাংবাদিক, লেখক ও মতপ্রকাশকারী ব্যক্তিরা সচেতন বা অচেতনভাবে শব্দের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট বাস্তবতা প্রতিষ্ঠা করেন। এমনকি আজকের দিনে টিকটকার, ইউটিউবার বা ভিউ  ব্যবসায়ীরাও এই শব্দ-নির্মাণের খেলায় অংশ নিচ্ছে, কখনো জেনে, আধা জেনে, বা  না জেনে।

                                                                      ফটো: এ আই থেকে বানিয়ে নেওয়া।

বাংলাদেশেও শব্দের এই এস্টাবলিশমেন্টের (প্রতিষ্ঠা) প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। জাতিকে "উপজাতি" বলা, মানবগোষ্ঠীকে "ক্ষুদ্র জাতিসত্তা" হিসেবে অভিহিত করা, কিংবা পার্বত্য অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির স্থানীয় নামগুলো  অনুবাদিত করে প্রতিষ্ঠিত করা তার উদাহরণ। যেমন, মায়ুং কপা কে  "হাতির মাথা" বা তাইনয়াখো কে "পুঙ্খিমোড়া" নামে প্রচলন করা হয়েছে, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির বিকৃত উপস্থাপন।

শব্দ কখনো একটি নিরীহ বাহন নয়। এটি একদিকে হতে পারে সংস্কৃতির রক্ষাকবচ, আবার অন্যদিকে হতে পারে রাজনীতির নির্মম অস্ত্র। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের চাপে অনেক সময় ভুল শব্দ প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

এমন বাস্তবতায় সাম্প্রতিক  ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বৈসু উৎসবের তীর্থ মেলার  "মাতাই পুখিরি" নামকরন দেখে আশার আলো দেখা যায়। কারণ, জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভূখণ্ডে, নিজস্ব ভাষায় নামকরণ তাদের সাংস্কৃতিক অধিকার ও স্বীকৃতির অংশ।

তবে অতীত অভিজ্ঞতা আমাদেরকে  সতর্ক করে এবং মনে করিয়ে দেয় যে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নামকরণ নিয়েও অনেক ভুল শব্দের প্রচলন হয়েছে বা এস্টাবিলিশড করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারসহ অনেক লেখক ও সাহিত্যিক এখনো আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে "ক্ষুদ্র জাতিসত্তা" বা "উপজাতি" হিসেবে উল্লেখ করেন। অথচ কোনো জাতি কখনোই "উপ" বা "ক্ষুদ্র" হতে পারে না; জাতি তার নিজস্ব আত্মপরিচয়ে স্বতন্ত্র এবং পূর্ণাঙ্গ।

ব্যাক্তি জাতি কি নামে পরিচয় হবে এটি সম্পূর্ণ তার বিষয়, 

আপনি চাইলে কাউকে রহিম মিয়াঁ, করিম মিয়াঁ, রহিম জাত করিম জাত ডাকতে পারেন না। আগে তাকে / তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা এই নামগুলোতে পরিচয় হতে চায় কি না। তাই লেখার ক্ষেত্রে বলার ক্ষেত্রে অবশ্যই তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার আদিবাসীরা দাবি তুলার পরও "আদিবাসী কিংবা ১৩ টি জাতির নাম"  না লিখে, ক্ষুদ্র,  উপ লিখতেছে,  ডাকতেছে, শোনায়তেছে, যা এমন আচরণ একদিকে যেমন রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক অশালীনতা অসভ্যতা প্রকাশ করে, তেমনি এটি একপ্রকার বর্ণবাদী মনোভাবেরও বহিঃপ্রকাশ। ব্যক্তি বা জাতি কী নামে নিজেদের পরিচয় দিতে চায়, সেটি তাদের নিজস্ব অধিকার। কাউকে জোর করে অন্য নামে পরিচিত করতে চাওয়া একধরনের ঔপনিবেশিক মানসিকতা।

তাই লেখক, গবেষক, সাংবাদিকসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে। নামকরণ ও পরিচয়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর মতামত জানতে হবে, তাদের সম্মান জানাতে হবে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় এই বিষয়টি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ রাষ্ট্রীয় ভাষা, নথিপত্র ও শিক্ষাব্যবস্থায় শব্দের ব্যবহার জনগণের চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলে।

ভবিষ্যতে, আমাদের এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত হয়ে, একটি অধিকতর মানবিক, গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ সমাজ নির্মাণ করতে হবে। এবং তা শুরু হতে হবে শব্দের যথাযথ ব্যবহারের মধ্য দিয়েই।


ধীমান ত্রিপুরা
বি.এস.এস(অনার্স), এম.এস.এস (নৃবিজ্ঞান) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। 









Post a Comment

0 Comments