১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পূর্ব ( নব্য বাংলাদেশ) পশ্চিম পাকিস্তান বিভক্ত হয় ব্রিটিশ এর হাত ধরে। ভোগোলিক মানচিত্রে বিভাজনে দায়িত্ব নেন র্যাডক্লিফ ব্রাউন। হিন্দু ও মুসলমান ছাড়া এ দুটি রাষ্ট্রে আরও বহু জাতি ও ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিভাজনের ভুল ধারায় উপেক্ষিত হতে থাকে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী। এভাবে উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়, যদিও এই অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীসমূহের ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি মূলত ভিন্ন।
ফটো: এআই থেকে বানিয়ে নেওয়া
আজ সেই উপেক্ষিত জনগোষ্ঠীরা নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শিখেছে । তারা চ্যালেন্জ করতে শিখেছে ভাষা, সংস্কৃতি, পৌশাক খাদ্যভাস টিকিয়ে রাখতে হবে, এগুলো বিলুপ্ত হওয়া মানে একটি জাতিগোষ্ঠী বিলুপ্ত। এই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে তাদের অধিকার, সংস্কৃতি ও স্বকীয়তা রক্ষার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। কেন এই আন্দোলন? আমার দেখা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধীনতার সম্ভাব্যতা, কারণ এবং ভবিষ্যৎ কৌশল কি হতে পারে- তা সংক্ষেপে-
সাংস্কৃতিক ও জাতিগত বৈচিত্র্য
পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩টি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী বাস করে—ত্রিপুরা, চাকমা, মারমা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, খিয়াং, খুমি, বম, লুসাই, পাংখোয়া, চাক, কুকি ও অন্যান্যরা। এদের ভাষা, ধর্ম, পোশাক, খাদ্যাভাস এবং সংস্কৃতি বাংলাদেশের মূলধারার বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর থেকে ভিন্ন। তাদের সংস্কৃতি ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্য, মায়ানমার এবং চীনের মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর সাথে অনেক বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ।
রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও বৈষম্য
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বহু বছর ধরে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণে হাজার হাজার আদিবাসী বাস্তুচ্যুত হন, তাদের পুনর্বাসনের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
১৯৮০-এর দশকে সমতল অঞ্চল থেকে লক্ষাধিক বাঙালি সেটেলারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তর করে স্থানীয় জনসংখ্যার ভারসাম্য পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এখনো দেওয়া হয়নি। অনেক সময় তাদের নিজস্ব ভাষা ও পোশাকে অবজ্ঞা করা হয় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ছাঁচে রূপান্তর ঘটানোর চেষ্টা হয়।
আন্তর্জাতিক তুলনা ও কৌশলগত দিক
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান এবং জনগণের জাতিগত বৈশিষ্ট্য ভারত, মায়ানমার ও চীনের সঙ্গে তুলনাযোগ্য। এসব দেশের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের অধিকার ও সংস্কৃতির প্রশ্নে সমর্থন আদায় করা একটি সম্ভাব্য কৌশল হতে পারে।
স্বাধীনতার সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় বহিরাগত সেনা শক্তির পক্ষে এই অঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে ১৩ টি জাতিগোষ্ঠীর সাথে যুদ্বেও জয়ী হওয়া অসম্ভব । তবে স্বাধীনতা অর্জন শুধুমাত্র ভৌগোলিক বা জাতিগত পার্থক্যের উপর নির্ভর করে না; প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং কৌশলগত প্রস্তুতি। বর্তমান বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় স্বাধীনতা অর্জনের পথ জটিল হলেও সাংস্কৃতিক স্বশাসন, সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং অধিকতর স্বায়ত্তশাসন অর্জন একটি বাস্তবসম্মত লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে।
এজন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি ও অধিকার টিকিয়ে রাখার জন্য একটি সুপরিকল্পিত ও কৌশলগত আন্দোলন প্রয়োজন। স্বাধীনতা একটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বাধিকারের প্রশ্নে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা আদায়ের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খোঁজা সম্ভব। সকল পক্ষের অংশগ্রহণ ও সংলাপের মাধ্যমে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলাই সময়ের দাবি। একই সাথে গুরুত্ব দিতে হবে সেটি হলো -
"রাষ্ট্রের ভিতর ১৩ টি জাতিগোষ্ঠী ত্রিপুরা, চাকমা, মারমা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, খিয়াং, খুমি, বম, লুসাই, পাংখোয়া, চাক, কুকি জনগোষ্ঠীররা যখন নিজেদের অধিকার, পরিচয়, ভাষা,,সংস্কৃতি, পোশাক, খাদ্যাভাস এর অবস্থান খোঁজে পাবে না তখন স্বাধীনতার দরজায় কড়া নাড়বে"
ধীমান ত্রিপুরা
বি.এস.এস ( অনার্স), এম.এস.এস ( নৃবিজ্ঞান) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
0 Comments