Deman Tripura

কোটা ইস্যু নিয়ে বন্ধুর কাছে আমার একটি চিঠি

              (কোটা ইস্যু নিয়ে বন্ধুর কাছে আমার একটি চিঠি)

@ধীমান ত্রিপুরা।



১২ এপ্রিল ২০২২/ 

প্রদীপ বন্ধু ( কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়) ,  

আমি বিন্দুমাত্র ভুলে যায়নি, কোটা  ব্যাপারে দুই লাইন লেখা লেখার অনুরোধগুলো। আমার কাছে এটি শুধু অনুরোধ মনে হয়নি, মনে হলো এক ধরনে উৎসাহ। যাইহোক আমি জানি ইতিমধ্যে তুমি হয়তো কোটা নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ, আর্টিকেল কলাম চোখবুলিয়ে ফেলছ। পড়ে ফেলছ হয়তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদিবাসী জন্য ৫% কোটা বহাল রাখা মৌখিক প্রতিশ্রুতিগুলো। তুমি হয়তো এটাও জানো আদিবাসীদের জন্য সবচেয়ে স্বস্তির বিষয় হলো আওয়ামীলীগ সরকার বাস্তবায়ন করুক বা না করুক কিন্তু প্রতিশ্রুতি দেয়, যা অন্য কোন জাতীয় দলের কাছে এই লক্ষনটুকুও দেখতে পায় না।  সাথে এটাও বলে রাখি বঙ্গবন্ধুর কন্যা এদেশের সংখ্যা কম জাতিগোষ্ঠীকে ( এখানে ক্ষুদ্র বললে অনেকে ভিন্ন অর্থ নিয়ে যাবে তাই কম সংখ্যক শব্দটি  ব্যবহার করছি) আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করছিলেন।  কিন্তু কেন জানি পরবর্তীতে এই শব্দগুলো আর মুখে নেয়নি। আদিববাসী জনগোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য বিশ্ববাসী এগিয়ে আসলেও বাংলাদেশ কেন জানি আদিবাসীদের সাথে একাত্ম পোষন করতে  ভয় পাচ্ছে।  তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীকে বাঙ্গালীর একাংশ ভয় পাওয়ার কারণগুলো আমার জানার পরিধি বাইরে। তাই সেদিকে আর না এগিয়ে কোটা ইস্যুগুলো উপলব্ধি করার সুবিধার্থে আমি কয়েকটি বিষয় শেয়ার করার অনুভব করছি,, সেটি হলো বিশেষ করে মুসলিম  বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী ১৩ জাতি গোষ্ঠী বিভিন্ন নামে ডাকে। যেমন ত্রিপুরারা ডাকে বাঙ্গালীকে """ওয়াইনসা কচোবসা""যার ব্যখ্যা করলে অর্থ দাড়ায় যারা (ওয়াইন) দোলনা মতো অন্য জনগোষ্ঠীরকে নাচায় তছনচ করে,,,,  এই শব্দে তুচ্ছতাচ্ছিল্য অবছাপ রয়েছে,,,৷ আবার মারমা তঞ্চ্যঙ্গা কালা কলা,,, বাঙ্গালুন,, ইংরেজরা black man ডাকে। কিন্তু বাঙ্গালীরা কেউ এই নামে পরিচয় হয় না এবং দিতেও চায় না।  বরং তারা ঠিক করেছে বাঙ্গালী নামে পরিচয় দিব।  আর আদিবাসীরাও  ঠিক করছে নিজেরা ত্রিপুরা চাকমা মারমা নামে পরিচিত হবে। নতুবা  ১৩ জাতি গোষ্ঠী আলাদা আলাদা  নামে ডাকতে বা  মনে রাখতে কষ্ট হলে ইনডিজিনাস( আদিবাসী)  ডাকতে পার। কিন্তু তারা ডাকবে না।  বরং তারা টিভি মিডিয়া পেপার বই পুস্তককে ক্ষুদ্র, উপজাতি নামে প্রচার করল। কিন্তু লেখালিখিতে ইংরেজ, ত্রিপুরা অন্যরা তাদেরকে কেউ ওয়াইনসা নামে লিখলো না,, বা black man নামে প্রচার করলো না। কিন্তু বাঙ্গালীরা ঠিকই সেটি  শুরু করে দিল। আর নিজেদের ক্ষেত্রে   বাঙ্গালী নামে লিখলো তাদের পরিচয়গুলো। এটি দ্বারা কিছুটা প্রমাণ হয় কে কোন জাতিকে কতটা সম্মান করে লিখতেছে বা প্রচার করতেছে।  আদিবাসীরা যেখানে " ওয়াইনসা "বাঙ্গালুন না লিখলেও তারা ঠিকই আমাদের পরিচয়গুলো তাদের দেওয়া নাম অনুযায়ী ক্ষুদ্র উপজাতি শব্দটি লিখলো প্রচার করলো। এমনকি আদিবাসীরা বাঙ্গালীকে বৃহৎ নৃগোষ্ঠী না ডাকলেও, তারা আদিবাসী ১৩ টা জাতিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ডাকলো।

কিন্তু এদেশে কিছু বাঙ্গালী বুদ্ধীজীবি এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করলেও খুব বেশী জোরালোভাবে অবদান রাখতে পারে নি। এই ধরনে নামকরণ নিয়ে  একটি প্রপঞ্চ শেয়ার করার প্রয়োজনবোধ করলাম।  সেটি হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নৃবিজ্ঞানী রাহমান নাসির উদ্দীন স্যার তাঁর একটি গ্রন্থে বৈসাবি বাঙ্গালীদের বানানো খিচুড়ি কিছুটা এইরকম লেখাতে  বিলাপ প্রকাশ করতে  দেখা যায়। তার এই সুন্দর লেখাতে কিন্তু সমাধানের পথ দেখাইতে পারে নি বা এড়িয়ে গেছেন। সেখানে তিনি বৈসাবি শব্দটি লিখতে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।  তিনি  বিষয়টিকে এভাবে লিখতেন পারতেন তাহলে আরো প্রশংসনীয় ও প্রানবন্ত হত।  কীভাবে?  সেটি হলোঃ তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩ টি জাতিগোষ্ঠি প্রতিবছর ১৪ এপ্রিলে তিনদিন একটি উৎসব পালন করে যেটি তাদের ঋতুচক্র ও জীবনব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।  তারা সবাই এই উৎসব পালন করলেও উৎসবের নাম ও পালন পদ্ধতিগুলো আলাদা। ১৩ টি জাতির এই উৎসবকে রাষ্ট্রে ১৩ ধরনে প্রচারের ব্যবস্থা অনীহা থেকে তিন জাতিগোষ্ঠীর থেকে প্রথম অক্ষরের উৎসবের নাম দিয়ে বৈসাবি নামে প্রচার করে।  নতুবা ১৩ তি জাতিগোষ্ঠির থেকে উৎসবের প্রথম অক্ষরে নাম লম্বা হবে বা উচ্চারণের বিরক্তিকর অজুহাতে সেদিকে আর এগোয়নি।  নতুবা ইংরেজী দিয়ে যেমন ঃ BSC..... উৎসব  এরকম করতে পারতো,, যার অর্থ B দিয়ে - বৈসু, বিঝু বিসু,বিসু,,s দিয়ে - সাংগ্রাই,,, C দিয়ে - চাঙহাই।  তাহলে নামটি সংক্ষিপ্ত ছোট এবং সব জাতিগোষ্ঠি উৎসবের নাম অন্তর্ভুক্ত হতো। ফলে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে একটি চেতনার প্লাটফর্মে এসে আদিবাসীরা সংঘবদ্ধ হতে পারবে। 

যাইহোক এবার মুল প্রসঙ্গে আসি বন্ধু। ইতিমধ্যে হয়তো তুমি গত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়  কোটা আন্দোলনের আমার সাড়ে ৪ মিনিটের মতো একটি বক্তব্য খেয়াল করেছ যেখানে আমি বলতে চেয়েছিলাম কোটা শব্দটি সাথে সাথে কোনভাবে মেধার সম্পর্ক নেই।  কিন্তু সমাজের এক শ্রেণি জনগোষ্ঠী " কোটা মানে মেধা কম" এই বাক্যটি যদি সমাজের সবাইকে বুঝাইতে পারি তাহলে যারা কোটা ভোগ করবে তারা হীনম্মণ্যতা ভোগবে,, অসম্মানজনক মনে করবে,, এবং সমাজ তাদেরকে কম মেধাবী বলে অসম্মান করবে।  এভাবে ধীরে ধীরে কোটা কৌশলে উঠিয়ে দেওয়া যাবে।  এমন ভিত্তিহীন অদুরদর্শী  ধ্যানধারনা জেনে বা না জেনে গা ভাসিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকও দেমাক বা অহংকারী জায়গায় থেকে ছাত্রছাত্রীকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় কোটা মানে মেধা কম । 

চলুন একটি ভিন্ন আঙ্গিকে ভাবি।

একটি দেশে কালচার সংস্কৃতি চর্চা ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার আশ্বাস দিলে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে আসবে। আমরা যদি খেয়াল করি বিশ্বে বিভিন্ন জায়গায় স্কলারশিপে কোন দেশ থেকে কতজন নিবে সেটি বরাদ্দ রাখা হয়।বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নাচ গান পারফর্মেন্স সংস্কৃতি বা তাদের মেধাগুলো দেখার সুযোগ পায় তাদেরকে এখানে আসার থাকার পরিবেশ দিয়েছে বলে। আমি যতোই মেধাবী হোক আমি কোনদিন বাঙ্গালী  হতে পারবো না, বা বাঙ্গালির মতো পারবো না। ঠিক তেমনি একজন বাঙ্গালী যতোই মেধাবী হোক সেই কোনদিন ত্রিপুরার মতো হতে পারবে না।  বা ত্রিপুরা মতো পারবে না সবকিছু। ফলে এ সমগ্র বিষয় চিন্তা করে এখানে বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি  বরাদ্দ সুযোগ সুবিধা রাখাকে  কম মেধার আশ্রয় স্থান বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে এদেশের কিছু স্বার্থবাদী জনগোষ্ঠী। এমনকি বাঙ্গালীকে অনুসরন করে,  জাতিয়ত্যাভিমান করে আমরাও বলতে পারি শুধু  তিন পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করলে  বিজ্ঞানী মংসানু মারমা, ড. অমিড চাকমা,  নৃবিজ্ঞানী প্রশান্ত স্যারের মতো অনেক আন্তর্জাতিক মানের মানুষ উঠে আসছে অথচ সেখানে বসবাসরত বাঙ্গালী কেউ উঠে আসতে পারে নি সরকারের বিদ্যুৎ এর সহযোগিতার নিয়ে, রেশন নিয়ে,বাজার দখল করেও,, আমরা কোনদিন এভাবে বলার চেষ্টা করবো না,,তাহলে তাদেরকে ছোট করার মতো হয়ে যাবে। আমরা শুধু এইটুকুই বলবো।

বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বা রাষ্ট্রের অবহেলায় প্রান্তিককীকরন হয়ে যাওয়া আদিবাসী মেধা ও সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রের কল্যানের ব্যবহার করার সময়োপযোগী থেকে তাদের কোটার ব্যবস্থাটা জোরালো প্রয়োজন। জোরালো প্রয়োজন এই জন্য যে,  পড়াশোনা, চাকরী পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে বাংলা দিয়ে প্রশ্ন করা হয়, এখানে বাদ পড়ে যায় দেশের ৫০টি জাতিগোষ্ঠীর ভাষা।

একটি প্রশ্ন যদি এভাবে হতো - 

"তাউসা মাই চাদো - ইংরেজী ট্রান্সলেট করো। এই প্রশ্নের ক্ষেত্রে ত্রিপুরারা এগিয়ে।  অথবা যদি বলে" বমা চারূরোক বাসা খিরোরুক- ভাবসম্প্রসারন লিখ।

এই প্রশ্নগুলো দেশে বড় বড় প্রফেসরগুলো উত্তর দিতে বারোটা বাজবে।  কিন্তু কলেজে পড়া একজন ত্রিপুরা ছেলে হাসিমুখে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। 

তাই অধিকাংশ পড়াশোনা বা চাকরী পরীক্ষায় একচেটিয়াভাবে বাংলা দখল করে ফেলছে।  যেখানে বাংলাভাষী অবশ্যই এগিয়ে থাকে তাদের মাতৃভাষায় প্রশ্নপত্রে। একইভাবে ত্রিপুরা রাজ্যে ত্রিপুরা ককবরক প্রশ্নপত্রে ত্রিপুরারা এগিয়ে। ইংরেজী ভাষা পড়াশোনায় ইংরেজরা এগিয়ে।  

১৯২১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ICS ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের ঢাবি থেকে একজনও চান্স পায় নাই। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত  চাকরীতে পশ্চিম পাকিস্তানরা পূর্ববাংলার মানুষকে সুযোগ কম দিত।  ১ম টা তুমি চিন্তা কর। কিন্তু দ্বিতীয় কথাটি কি এটি প্রমাণ করে! পূর্ব বাংলার মানুষ কম মেধাবী?  তাই চাকরী হয় নাই!  

একদম না!  যতোই মেধাবী হোক নিয়োগ দিবে না। আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও ঠিক একইভাবে প্রযোজ্য।  যেখানে তাদের পরিচয় ক্ষুদ্র উপজাতি নামে উপস্থাপন করে,  তাদের পৌশাক সংস্কৃতি ভাষা মেধাকে প্রচারের জন্য আলাদা টিভি চ্যানেল নেই, জাতিয় পত্রিকায় আদিবাসী পাতা নেই। যেখানে আদিবাসী ভাষাতে খবর প্রচারিত হবে।  অথচ দেশের ২০ + টিভি চ্যানেল জাতিয় পত্রিকায় বাংলা ভাষায় খবর প্রচারিত হয় সেখানে আদিবাসীদের ছিটেফোঁটা নেই। so সেই জায়গায় এটি সুস্পষ্ট আদিবাসী সংস্কৃতি ভাষা পোশাক উৎসব বিশ্বাস ও ধর্মকে সমানভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে  না, সেখানে তাদের মেধাকে গুরুত্ব দিয়ে কোটা ছাড়ায় চাকরী  দিবে সেটি আদিবাসীদের কাছে কল্পনা মতো হয়ে গেছে। যদি কোটা থাকে তাহলে তাদের মেধা, পৌশাক, ভাষা, সংস্কৃতিকে রাষ্ট্র নিয়োগ দিতে অংশগ্রহণে সুযোগ দিতে বাধ্য থাকে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রীর মতো সভ্য দূরদর্শী ও গুটি কয়েক বুদ্ধীজীবি ৫% কোটা আদিবাসীর জন্য সব জায়গায় রাজি হলেও, একশ্রেণির জনগোষ্ঠী যারা আদিবাসী মেধা ও উন্নয়ন মন থেকে  চায় না তারা বিভ্রান্ত করছে এবং নতুন নতুন শব্দ দিয়ে কথা বলে, কালক্ষেপণ করে, সমাধানের ইস্যুটা ঘোলাটে করে ঝুলে রেখে দিয়েছে। 

এভাবে ঝুলে আছে 

পার্বত্য চট্টগ্রামে ভুমি নিষ্পত্তি ইস্যু

আদিবাসী ইস্যু

আদিবাসী সংস্কৃতিবান্ধব উন্নয়নের ইস্যু।

তুমি রাগ করবে রিপ্লাই না দিলে, তাই তাড়াহুড়ো করে একটি চিঠি দিয়ে রিপ্লাই দিলাম। বুঝে নিও এবং পড়ে নিও। কিছু কিছু জায়গায় আরো গ্যাপ পড়ে থাকতে পারে  তথ্য উপস্থাপনায় ।  কোন একদিন বই লিখবো বিস্তারিত এই সকল গ্যাপগুলোকে নিয়ে, অন্তত উন্মোচন হোক অন্তরালে বা গোপন মহল থেকে বেরিয়ে সকল ধরনে মিথ্যা বানোয়াট শব্দ ও জ্ঞানের রাজনীতিগুলো যেখানে আদিবাসী বা মানবজাতির কল্যান কোনদিন নিহিত ছিলনা কথাগুলো। 

ভালো থেকো বন্ধু।

ধীমান ত্রিপুরা (নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ) 


Post a Comment

0 Comments