বিশ্ব যখন এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক স্নায়ু যুদ্ধে লিপ্ত, তখন দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রে এক অদৃশ্য চালকের আবির্ভাব হয়—নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনুস। বাংলাদেশে তরুণদেরকে আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করে তিনি উঠে আসেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছায়া-নেতা হিসেবে। কিন্তু এই আন্দোলনের পেছনে ছিল বহুদিনের ছক, গভীর টেবিল ওয়ার্ক ও হোম ওয়ার্ক ।
ফটো : এআই থেকে বানিয়ে নেওয়া
শান্তির প্রতীক হিসেবে খ্যাত এই ব্যক্তিত্বকে হঠাৎ করে দেখা যায় আন্তর্জাতিক কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে।
তবে সাম্প্রতিক কালে আন্তর্জাতিক ও দক্ষিণ এশীয় ভূ-রাজনীতিতে তাঁর নাম ঘুরেফিরে উচ্চারিত হচ্ছে এক নতুন প্রেক্ষাপটে—একটি অঘোষিত কূটনৈতিক গেম প্ল্যানের অংশ হিসেবে। একে একে খুলতে থাকে ছক কাটা রাজনৈতিক দাবার গুটি।
যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রভাবকে আটকে রাখতে এশিয়ায় নতুন মিত্র খুঁজছে, বিকল্প করিডোর খুজঁতেছে । যেখানে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন গুরুত্বপূর্ণ ছিল , পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মায়ানমারের আরাকান, সেভেন সিস্টার —সবই মার্কিন কৌশলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিছু পর্যবেক্ষক দাবি করছেন, ড. ইউনুস এই সমীকরণে একটি ‘সফট ইনফ্লুয়েন্স’ হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু ইউনুস সেই সেন্টমার্টিনকে বাদ দিয়ে প্রস্তাব দেন মায়ানমারের করিডোরে মার্কিন প্রক্সি ঘাঁটি স্থাপনের। এর মাধ্যমে আমেরিকার চীনকে চাপ দেওয়ার কৌশলে তিনি হয়ে ওঠেন মূল সহযোগী। মায়ানমারের করিডোরে মার্কিন ঘাঁটি স্থাপনের—যা চীনের জন্য একটি বড় ভৌগোলিক চাপ হয়ে দাঁড়ায়।
ইউনুসের পরিকল্পনা স্পষ্ট: দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে আমেরিকানদের বিকল্প করিডোর তৈরি করতে হবে—বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন নয়, বরং মায়ানমারের আরাকানই হবে আসল কৌশলিক ঘাঁটি। ভারত যেন পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাধীনতাকামী আদিবাসীদেরকে সহযোগিতা না করে, সে লক্ষ্যে ভারতের সেভেন সিস্টারের অভ্যন্তরে ইউনুস ছড়িয়ে দেন সাবধানে পরোক্ষ থ্রেড। ভারতের কানে যায় এক অদ্ভুত বার্তা—“তুমি যদি বাংলাদেশের গেমে নাক গলাও, তোমার ঘরেই আগুন জ্বলবে।”
ভারত, চীন, রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে শক্তির ভারসাম্য এখন অত্যন্ত জটিল। ভারত চায় তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামও একটি ছায়া হুমকি হয়ে আছে বাংলাদেশের জন্য যা ভারতের সুবিধাজনক রাজনীতিও বটে । এদিকে চীন চাইছে মায়ানমারের করিডোর ধরে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছাতে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ড. ইউনুসের মায়ানমার প্রক্সি ঘাঁটি প্রস্তাব বিশ্লেষকদের কৌতূহল বাড়িয়ে তুলেছে।
মায়ানমারে প্রস্তাবিত ‘মানবিক করিডোর’ প্রকল্পটিকে নিয়ে সংশয় রয়েছে। এটি কি কেবল মানবিক সহায়তা, নাকি একটি সামরিক-গোয়েন্দা কৌশলের অংশ?
প্রফেসর সাহেব মানবিক করিডোর নামে মায়ানমারে সাহায্য পাঠাচ্ছেন, চীনের সাথে দৃশ্যত ভালো সম্পর্ক রাখছেন, অন্যদিকে মায়ানমারের ভেতর মার্কিন ঘাঁটি বসানোর ছক বাস্তবায়ন করছেন। এর মধ্যেই বাংলাদেশ সেনাপ্রধানকে রাশিয়ায় পাঠিয়ে রাশিয়ার সাথেও রেখেছেন একধরনের সম্পর্ক। আর ভারত ব্যাস্ত হয়ে পড়ছে ভারত-পাকিস্তান সম্ভাবনা যুদ্ধে।
তিনি যেমন রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক রাখছেন, চীনের সাথে যোগাযোগ রাখছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি নতুন ধরণের অংশীদারিত্বের চেষ্টা করছেন। ফলে একটি মধ্যমপন্থী, অথচ সক্রিয় কূটনীতির চেহারা ফুটে উঠছে।
ভারত, মায়ানমার, চীনের সহযোগিতায় পাহাড়ি আদিবাসীরা যদি ইউরোপ-আমেরিকায় বার্তা দিতে পারে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা সংস্কৃতি, পোশাক, ধর্ম, ও ভাষার খাদ্যাভাস দিক দিয়ে ভারত, মায়ানমার, চীন কিংবা খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর ইউরোপ আমেরিকান সাথে সংযুক্ত—তাহলে তাদের স্বাধীনতার দাবি আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে পারে।
যদিও এখনো কোনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রমাণিত কিছু নেই, তবুও বিশ্ব রাজনীতির মাঠে ড. মুহম্মদ ইউনুস নামটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। বাস্তবতা বা সম্ভাবনা—উভয় দিক থেকেই এটি পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে।
একই সাথে প্রশ্ন রয়ে যায়—এই গেমের শেষ চাল কোথায়? ইউনুস কি সত্যিই একটি নতুন ইতিহাস লিখছেন, নাকি তিনিও বড় কোনো আন্তর্জাতিক এজেন্ডার খেলোয়াড়?
ধীমান ত্রিপুরা
বি.এস.এস (অনার্স), এম.এস.এস (নৃবিজ্ঞান) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
0 Comments