Deman Tripura

কর্মচঞ্চল নগরীতে বাবা-ছেলে

নগরের আভিজাত্য এলাকায় বসবাস করেন দাউয়িংমা ও দাউয়িংফা। পেশাগত জীবনে তারা সফল এবং চিন্তাশীল এক দম্পতি। তাদের একমাত্র পুত্রের নাম দাউয়িং। ছেলের জন্মের আগেই তারা নানা পরিকল্পনায় মগ্ন ছিলেন—শিশুটি যেন প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়, নৈতিকতায় আদর্শ হয়ে ওঠে, আর মানুষের মতো মানুষ হয়। দাউয়িংফা বিশ্বাস করেন, এই ছেলেই একদিন তার চিন্তার প্রতিফলন ঘটাবে সমাজে।

অন্যদিকে দাউয়িংমা গর্ভাবস্থাতেই  নিয়মিত বই পড়তেন, বহু অজানা সঙ্গীত শুনতেন, এমনকি গাণিতিক ধাঁধা, বিভিন্ন ধরনে জটিল আইকিউ সমাধান করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, গর্ভাবস্থার মস্তিষ্ক গঠনের সময় সন্তানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে এই অভ্যাসগুলো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দাউয়িং যখন জন্ম নিল, ছেলের  হাতে প্রথম  কলম গুঁজে দিয়ে শিক্ষার প্রতীকি স্পর্শ করতে দিয়েছে দাউয়িংফা। 

তখন থেকে শুরু হয় দাউয়িং এর  জীবন ঘিরে এক সুচিন্তিত মহা পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। বেবি মাইলস্টোন এর  প্রতিটা স্টেপ  তারা মনোযোগ দিয়ে অনুসরণ করেন। এই  মাইলস্টোন চার্ট অনুযায়ী কোথাও ডেভেলপমেন্ট ডিলে হচ্ছে  কি না দাউয়িংকে  সার্বক্ষণিক মনিটরিং এ রাখেন বিশেষ করে দাউয়িংফা। 


                                                           ফটো: এআই থেকে বানিয়ে নেওয়া 

দেখতে দেখতে দাউয়িং এখন ৩ বছর। সবেমাত্র ব্রেন ডেভেলপমেন্ট  স্টেজ পার করছে সেই। এখন সে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করে। তার কৌতূহল সীমাহীন—চারপাশের জগৎ তাকে অবাক করে। এই বয়সে যতোটুকু পারার কথা,  করার কথা ততটুকু পারে সে। প্রশ্ন করা শিখে গেছে চারপাশের বস্তুকে নিয়ে। নতুন নতুন জিনিসের প্রতি আগ্রহের শেষ নেই তার। জানার জন্য শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন করে যাচ্ছে।  কারন তার কাছে পৃথিবীর সবই নতুন। যত্ন করে তার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে দাউয়িংফা। আজকাল দাউয়িং খুব কঠিন প্রশ্নও করে বসে, অনেকসময় দাউয়িংফার ছেলের  উত্তর গুছিয়ে দিতে কষ্ট হয়।  দাউয়িংফা জানে একটা সময় ছেলেকে নিজেই উত্তর খোঁজে নিতে হবে, কারন কত কি  অজানা মানুষের,  তাই তিনি শুধু জানা প্রশ্নগুলো যথাযথ ও অর্থবোধক উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন।   অজানাগুলো বলে দিচ্ছে ছেলেকে এভাবে :
বাবা দাউয়িং, এগুলো অনেক কঠিন, উত্তর বললে ভুল হবে, এই প্রশ্নের উত্তর এখন না বলাই ভালো। তুমি বড় হলে নিজেই খুঁজে নিবে।"
তখন ছেলেও উল্টো প্রশ্ন করে, বাবা তুমি তো আমার আগে পৃথিবীতে আসছো, তোমার তো বেশী জানার কথা। এভাবে বাবা ছেলের কথোপকথনের আর শেষ হয় না।

একদিন দাউয়িংফা সিদ্ধান্ত নেন ছেলেকে নতুন একটি জায়গায় নিয়ে যাবেন—নদীর ধারে। তাই আগেই থেকে ছেলে প্রশ্ন করবে জেনে নতুন জায়গায় সম্পর্কে গুগল বইপুস্তক ঘাটাঘাটি করে পড়াশোনা করে রেখেছে। দাউয়িং তখন পাঁচ বছর বয়সী। কিন্তু আজ নতুন স্থান নিয়ে তার আগ্রহ থাকলেও নদীর ধারে পৌঁছে সে নিরুত্তাপ। তা দেখে দাউয়িংফা বিস্মিত হন। তখন দাউয়িংফা নিজেই বলা শুরু করেন—

"এই যে দেখো, পানির শব্দ শুনছো? কলকল করে যেন আনন্দ করছে। পাহাড় থেকে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এখানে এসে মিলিত হয়েছে বলে হয়তো, যেমন তুমি আমাদেরকে দেখা পেলে খুশিও।"

দাউয়িং বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে: "কিন্তু বাবা, পানি কি কথা বলতে পারে? তুমি কিভাবে জানলে তারা সুখী?"

দাউয়িংফা হেসে বলেন: "না, পানি কথা বলতে পারে না। কিন্তু আমি ওদের মন বোঝার চেষ্টা করি। যেমন তুমি মুখে না বললেও বুঝতে পারি তুমি আমাদের কতোটা ভালোবাসো, একা রেখে গেলে তুমি  কাঁদবে, নতুন জায়গা পেলে তুমি খুশি হও। তুমি কি এসব কথা আমায় বলেছো কখনো?"

দাউয়িং মাথা  নাড়ে ( না সুচক)। তখন দাউয়িংফা বলেন, "ঠিক সেভাবেই আমি গাছপালা, নদী, আকাশ, পাখিদের মনের কথা বোঝার চেষ্টা করি।"  প্রশ্ন শুরু করলে আর থামে না এভাবেই চলছে বাবার ছেলের কথোপকথন.....


                                         (২)
অনেক বছর পর প্রথমবারের মতো ট্রেনে চড়ে বাবা-ছেলে। দাউয়িং তখন আট বছরে পা দিয়েছে। সে প্রশ্ন করে—

"এই ট্রেনে কতজন মানুষ আছে বাবা?"

"আনুমানিক এক হাজার," উত্তর দেন দাউয়িংফা।

"নারী-পুরুষ কতজন?"

"সমান সংখ্যক ধরতে পারো।"

"এই ট্রেনের দাম কত হতে পারে?"

তাদের চারপাশের যাত্রীরা ছেলেটির দিকে তাকায় বিস্মিত চোখে, কেউ কেউ বিরক্ত ভঙ্গিমায়।  দাউয়িংফা নম্রভাবে বলেন:

"আমার ছেলে অনেক প্রশ্ন করে। আমি চেষ্টা করি সব উত্তর দেওয়ার, ভুল হলেও। কারণ আমি জানি হয়তো আপনাদের অনেকের কাছেই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আরও ভালোভাবে জানা আছে। আমি ভুল উত্তর দিলে ক্ষমা করবেন।"

দাউয়িং প্রশ্ন  করে  "তবে বাবা, প্রশ্ন করলে তো দুঃখিত হতে হয় না, তাই না?"

দাউয়িংফা মাথা নেড়ে বলেন: "না, প্রশ্ন করা অপরাধ নয়। কিন্তু যদি জানা কথার ভুল উত্তর দিই, তখন ক্ষমা চাওয়া উচিত।"

এভাবে প্রশ্ন উত্তরে প্রতিমুহূর্তে  কেটে চলছে দাউয়িং এর শৈশব।
দাউয়িং এখন দৈনন্দিন জীবনের নিয়মশৃঙ্খলায় অভ্যস্ত। সকাল ছয়টা, এগারোটা, সন্ধ্যা ছয়টায় তাকে পানি খাওয়ানো হয়—ঘড়ির এলার্ম দিয়ে। দাউয়িংফা বিশ্বাস করেন—পর্যাপ্ত পানি শরীর পরিষ্কার রাখে, রোগ প্রতিরোধ করে। তিনি মনে করেন, আধুনিক চিকিৎসার শেষ পরিণতিও বলে—"পানি খাও, ফল খাও, সবজি খাও, ব্যায়াম কর।" তাই ডাক্তারি ওষুধে না গিয়ে জীবনধারায় শুদ্ধতাই শ্রেয়।

একদিন বুধবার ২২ তারিখ ২০১৮,  দাউয়িং কোন  প্রশ্ন না করায় দাউয়িংফা নিজেই বলা শুরু করেন:
"জানো বাবা, ছোটবেলায় আমরা বলতাম—আমার হাত ধরো মা। কিন্তু বড় হলে মা-বাবা আর বলেন না, আমাদের হাত ধরো। তখন আমাদের বুঝে নিতে হয়, তাদের হাত ধরা এখন আমাদের দায়িত্ব।"
তখন দাউয়িং হঠাৎ কি মনে করে অন্য আরো একটি প্রশ্ন করলো-
: "দমবন্ধ মানে কী?" বাবা?

দাউয়িংফা বলেন:
"ভূমিকম্পে বিল্ডিং ভেঙে পড়েছে, আমি একা চাপা পড়ে আছি। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমার শরীরের ওপরের মাটি আর স্ল্যাব সরাতে যদি কেউ আসে—আমি সবকিছু দিয়ে দিতে চাই, শুধু একটু নিশ্বাসের জন্য। ডুবে গেলে যেমন মনে হয়—এই বুঝি মরছি, সেই অনুভবটাই দমবন্ধ। তুমি যদি পুকুরে ডুবে দেখো, বুঝবে কেমন লাগে।"

দাউয়িং আবার  জিজ্ঞেস করে, তুমি তো প্রচুর বই পড়ো বাবা: "বই পড়ে কী হবে?"
"একজন মিথ্যাবাদী লেখকও বই লেখার সময় সত্যের কাছাকাছি যেতে চায়। না পারলে রম্যরচনা, ব্যঙ্গ, কার্টুন লেখে। কিন্তু সত্য প্রকাশের একটা চেষ্টা সে করেই। বই লেখা মানে নিজেকে এবং অন্যকে জানানো, তাই বই পড়া মানে সত্যকে  জানার ও ছোঁয়ার চর্চা।"

এভাবে সবসময় প্রশ্নের উত্তর এর বাদেও তাদের একটি স্পেশাল দিন আছে। সপ্তাহের শুক্রবারের একটি দিন ।  সময় ১ ঘন্টা।  দায়াঁ রেনডমলি যা খুশি প্রশ্ন করতে পারবে এদিনে- তাই শুরু করে দিয়েছে ছেলেও -
বাবা "বয়স্ক দাদুরা ছোটদের মতো আচরণ করে কেন?"

দাউয়িংফা বলেন:
"বৃদ্ধ বয়সে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়, জীবনসঙ্গীদের হারিয়ে মানুষ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। তখন নতুন বন্ধুত্ব গড়তে হয়, ছোটদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। কিন্তু গভীর অনুভবগুলো তারা প্রকাশ করতে পারে না, কারণ সমবয়সীরা তখন আর পাশে থাকে না। তখন তারা বুঝে ফেলে তার মতো সময়বয়সীর সংখ্যা কমে আসছে, বয়সের কারনে সময়বয়সী কাছেও ছুটটতে পারে না— আর একসময় তাদের দুনিয়া ছোট হতে হতে শুধু বিছানা পর্যন্ত এসে ঠেকে। সেখানেই শেষ পৃথিবী।"

শেষ পৃথিবী বলাতে দাউয়িংফা স্মরণ করেন তার বাবার  কথা: ছেলেকে বললেন। জানো বাবা!
" তোমার দাদু বলতেন, আমি ছেলেমেয়েকে পড়াই, কারণ আমি জমির কাগজ বুঝি না, কোর্টের কাজে ঠকে যাই। আমি চাই তারা যেন জেনে বুঝে জীবন গড়তে পারে। আমার মতো এই সমস্যা যাতে তাদের ফেস করতে না হয়।

দাউয়িং আবার প্রশ্ন করে  : তাহলে বাবা, তোমাদের  তরুন জেনারেশন কি অনেক বেশি জ্ঞানী ছিল?"

দাউয়িংফা বলেন:
"তরুণ বয়সে আমিও তাই ভাবতাম। কিন্তু তখনকার জ্ঞান ছিল বইয়ের পাতা আর পরীক্ষার খাতায় সীমাবদ্ধ। সমাজ বদলাতে সেই জ্ঞান যথেষ্ট নয়। নিয়ম তৈরি না বুঝে বিশ্লেষণ করে ফেলতাম, ইতিহাস না পড়ে উপদেশ দিতাম। তখন বুঝতাম না এটা টেকসই জ্ঞান নয়, বুঝতাম না তখন আগেই শব্দ এস্টাবিলিশড করতে হয়, তারপর ঐ শব্দকে ধরে ন্যারেটিভ দাড় করায়তে হয়, তারপর এটিকে মানুষের কৌতুহলের পর্যায়ে  নিয়ে যেতে হয়, কেউ যদি সেই ন্যারেটিভ এর অংশ নিয়ে গবেষনা করতে উদ্ধুদ্ধ হয় আর সেটি যদি সমাজে প্রভাব ফেলে তাহলে সেটিই জ্ঞান।  এই ধারনা তখন ছিল না আমাদের। 
দাউয়িং হয়তো বুঝতে পারে নি, কিন্তু আঁচ করতে পেরেছে বাবার কথাগুলো......


                                        (৩)
ছোটবেলায়  দাউয়িংফা একদিন ছেলেকে খেলনা কিনে দিয়েছিল।  কারণ সে বাড়ির ঠিকানা আর মোবাইল নম্বর মুখস্থ বলতে পেরেছে এবং টিভিতে দেখা কার্টুনগুলো গল্প আকারে বাবাকে শোনায়তে পেরেছিল তখন।  তাই আজ সেই খেলনা নিয়ে দাউয়িং আবার প্রশ্ন করে: তবে আজকের প্রশ্নের ধরনটা একটু অন্যরকম। 

" বাবা এটা আসলে কী?
"এটা অন্য গ্রহের নভোযানের অনুরুপ খেলনা।"

"তুমি কীভাবে পেয়েছো তখন?"

"বিজ্ঞানীরা কল্পনা করে কম্পিউটারে ডিজাইন করে, পরে খেলনার কোম্পানিগুলো তা তৈরি করে।"

"মানুষ কি এই নভোযান দেখেছে?"

"হ্যাঁ, কেউ কেউ। অনেকে কল্পনা করে সিনেমা বানায়, ছবি আঁকে। মানুষ কল্পনায় আনন্দ পায়, সেই আনন্দে পৃথিবী গড়ে আবার ধ্বংসও করে।"

দাউয়িং বলে: "বাবা, একটা শেষ প্রশ্ন, একটা  জোকস বলো, কিন্তু আমি হাঁসবো না।"

দাউয়িংফা বলেন:
"যেদিন ব্যাংকে কলম চুরি যাওয়ার ভয়ে কলম বেঁধে রাখতে হবে না, আর পাবলিক টয়লেট (শৌচাগার)  পরিষ্কার থাকবে—সেদিন বুঝে নিও, দেশ উন্নত হয়েছে।"

গল্প শেষ নয়, কারণ দাউয়িং বড় হচ্ছে, প্রশ্ন আরও আসবে, উত্তর খোঁজার চর্চা চলবে। একদিন সে নিজেই এই শহরের কোলাহলের মধ্যে এক চিলতে শান্তির খোঁজ করবে—যেখানে নদী কথা বলে, গাছপালা অনুভব করে, আর মানুষেরা সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠে।

(বি:দ্র: ত্রিপুরা জাতিরা বিশ্বাস করে দাউয়িংমা এবং দাউয়িংফা সৃষ্টির আদি নারী পুরুষ)


ধীমান ত্রিপুরা
বি.এস.এস (অনার্স), এম.এস.এস (নৃবিজ্ঞান) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।



Post a Comment

0 Comments