Deman Tripura

পার্বত্য চট্টগ্রামে ঐতিহ্যবাহী ত্রিপুরাদের বৈসু

ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী প্রধান উৎসব বৈসু । প্রতিবছর এই বৈসুতে  ত্রিপুরারা তৈবুঙমা (গঙ্গাদেবী),  পৃথিমাকে (পৃথিবী) ফুল দিয়ে প্রণাম করে,  নতুন পোশাক পরে গান বাজনা বৈচিত্র্য খাবার-দাবার, পিঠা, "সুকই" খেলার  উৎসব আয়োজন করে থাকে।তারা সারাবছর এই দিনটি জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। 

                            ফটো: বৈসু উপলক্ষে কলসিতে করে  পানি এনে   বটবৃক্ষে পানি ঢালতেছে ত্রিপুরা মেয়েরা

এমনকি তাদের সংস্কৃতির একটা অংশ মৌলিক ছাপ হিসেবে পরিস্ফুটিত হয় এই দিনগুলোতে । আর এই বৈসুর সময় সীমা হলো মাত্র তিন । যথা:  হার বৈসু (চৈত্র শেষ ২য় দিনে)  , বৈসুমা ( চৈত্র  শেষ দিনে), বিসিকাতা বা আতাদাক ( নতুন বছর)। 

বৈসু তে অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রামে  ত্রিপুরারা সকাল সকাল ফুল তুলে   নদী / ছড়ার পানিতে এবং মাটিতে এই দুই জায়গায়  ফুল  দিয়ে প্রনাম করে থাকে। 

ফটো: সিন্দুকছড়ি নদীর পানিতে ত্রিপুরা তরুন তরুনীরা ফুল দিয়ে "তৈবুঙমাকে" প্রনাম জানাচ্ছে। 


চলুন আমরা এই তিনদিন বৈসুর ঐতিহ্যবাহী খাবারে সাথে পরিচিত হয় । 

গৈন্ধ/মই জারবোং সংজাক (পাঁচন), ওয়াসুইঙ দায়ো মইখাঁ প্রৈঙজাক ( বাঁশের চোঙ্গায় রান্না করা মাংস), আ প্রৈঙজাক( বাঁশের চোঙ্গায় রান্না করা মাছ), তাউখাঁ গুদাইজাক( মুরগি মাংসকে গুটো করা খাবার), খাইঙগারাই বাই মইয়া রুজাক(কাকড়া দিয়ে বাঁশকোঁড়ল সিদ্ধ), ববোক চাখৈই( সোডা জাতীয় দিয়ে মাংসের নাড়ীভুড়ী রান্না), খাইবু রয়ো শাউকুমু (চালের গুঁড়া দিয়ে জল শামুক), হাঙ্গর লাকসু(সিদ্ধ করা শুটকি হাঙ্গর ভর্তা), বেরমা লাকসু( আগুনে পোড়ানো শুটকি ভর্তা), পুঁখা লাকসু(সিদ্ধ করা ছাগলের মাংস ভর্তা), তাউখাঁ লাকসু(সিদ্ধ করা মুরগি মাংস ভর্তা, আ সেজাক( মাছ ভাজি বা ফ্রাই), মইখাঁ য়াউজাক( তেল দিয়ে মাংস রান্না করা খাবার), আ মইখাঁ হাঁজাক( আগুনে ছেক দেওয়া বা আধুনিক বারবিকিউ), ওয়াউখাঁ পংরি( টক দিয়ে শুকরে মাংস সিদ্ধ করা ), আথোক কাথাং বতই খালাইজাক(চিংড়ি মাছের স্যুপ), লাই বাই আ মুজাক( কলা পাতায় মুড়িয়ে আগুনে ছেক দেওয়া মাছ) , সাউকুমু বাকলা ইজাক ( তিল দিয়ে মচলিয়ে কচলানো থানকুনি পাতা)। 

পিঠা ও মিষ্টান্ন খাবারের তালিকায় রয়েছে 

 - মামি সংজাক( বিনি চাল রান্না), মামি পঙজাক( বিনি চাউলকে বাষ্প দিয়ে রান্না করা খাবার), আওয়াঁ সংজাক( চালের গুঁড়া দিয়ে রান্না করা পিঠা রসমালাই টাইপে), আওয়াঁ সেজাক(চালের গুঁড়া  দিয়ে তেলে ভাজা পিঠা ) , মাইসি সংজাক( তিল), আওয়াঁ বাথাই (কলা পাতায় মুড়ানো পিঠা) ।

আর অনেকে সামর্থ্য অনুযায়ী আয়োজন করে বাজারের মিষ্টি ,বিস্কুট, আপেল ,আঙ্গুল, কমলা, তরমুজ, কলা, জুস, শরবত, নুডলস, বিরিয়ানী, পোলাও, পায়েস , "মই খাজি"  ইত্যাদি । 

এভাবে বৈসুর দিনগুলোতে প্রতিটি পরিবার সামর্থ্য অনুযায়ী খাবার আয়োজন ও আপ্যায়ন করে থাকে । তাদের বিশ্বাসের বদ্ধমূল হলো কেউ এই দিনগুলোতে খালি মুখে ফিরে গেলে গৃহস্থে অমঙ্গল হয় , তাই দিনটিতে দরজা খোলা থাকে অতিথিকে স্বাগতম জানানো জন্য।

এই তিনদিন বৈসুকে কেন্দ্র করে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীরা  বৃদ্ধ বয়স্কদেরকে কলসি ভর্তি পানি দিয়ে সকালে গোসল করায়। বটমূলে পানি ঢালে ( ৭ কলস)

এছাড়াও এই তিনদিন বৈসুকে কেন্দ্র করে প্রতিটি দিন অনুযায়ী এই উৎসবে খাবার দাবার হতে শুরু করে বিভিন্ন কার্যকলাপ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় । যেমন: 

হার বৈসু দিনে ডাংদু, সুমো, চপ্রেঁ সুকই,  বাশঁ বেত শিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে এবং এই দিনে  "মাতাইপুখিরি "  তীর্থ মেলা হয়। ঘরবাড়ি পশুপাখি পরিচর্যা করার পাশাপাশি পুষ্পসমারোহে জলে ও স্থলে সৃষ্টিকর্তা কাছে প্রার্থনা ও পূজা করা হয় ।  এই হার বৈসুর দিনে   মাছ ধরলে "তৈবুঙমা" ( গঙ্গা দেবী) তার প্রতি অবিচার করে না।  

বৈসুমা:এইদিনে সকল বিভেদ ভুলে এমনকি শত্রু হলেও পরস্পরের সাথে দেখাসাক্ষাৎ ও বিভিন্ন ধরনে খাবার-দাবার গ্রহন করে থাকে । সামাজিকভাবে কিছু ট্যাবু রয়েছে এ দিনটিতে। যেমন নিজের জন্মের বার এদিনে পড়লে নিজ বাড়িতে ভাত খাওয়া নিষেধ, খেতে হয় অন্য বাড়িতে গিয়ে, দিনের বেলায় ঘুমানো নিষেধ। এইদিনে কোন ধরনে প্রাণী হত্যা  করা যাবে না। 

বিসিকাতা/ আতাদাক:  ছোটরা বড়দেরকে পা ছুঁয়ে প্রনাম করে। যুবকযুবতিরা সুগন্ধি জাতীয়  তেল, সাবান,  বডি স্প্রে বয়স্কদের মাখায়। 

                               ফটো: বৈসু উপলক্ষে  "বিসিকাতা" দিনে বয়স্কদেরকে সুগন্ধি জাতীয় মাখিয়ে দিচ্ছে

 মাছ মাংস পোলাও সামর্থ্যনুযায়ী এ দিনে সকল আমিষ নিরামিষ খাবার আয়োজন করা হয় । বিবাদ হতে শুরু করে সকল ধরনে খারাপ কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকে কারন তাদের বিশ্বাস এই দিনগুলোতে ভালো কাটাতে পারলে বাকি দিনগুলোও ভালো যাবে । তাই সকলে মিলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে দিনটাকে ভালোভাবে উপভোগ করার ও ভালো রাখার ।   

সুতরাং পরিশেষে বলবো আনন্দ উৎসবে ভাল দিন কাটুক ত্রিপুরাদের এই বৈসু , বার বার শুভ ও পবিত্র বার্তা নিয়ে ফিরে আসুক তাদের এই আনন্দের দিনগুলো । 


ধীমান ত্রিপুরা 

বি.এস.এস (অনার্স), এম.এস.এস (নৃবিজ্ঞান), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


Post a Comment

2 Comments

  1. Karunanidhan debbarmaApril 12, 2025 at 7:38 PM

    Karunanidhan debbarma

    ReplyDelete
  2. আপনার পোস্ট টি খুব সুন্দর হয়েছে, তবে একটি মাত্র গোত্রের বলে মনে হয়, তবু ও ধন্যবাদ

    ReplyDelete